মারাঠা অধিগ্রহণ

প্রথম ঈঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮২)

  • পেশােয়া মাধব রাও -এর মৃত্যুর পর তার ভাই নারায়ণ রাও পেশােয়া হন ।
  • কিন্তু তার পিতৃব্য রঘুনাথ রাও বা রাঘােবা পেশােয়া পদ দখলে উন্মুখ ছিলেন । তার চক্রান্তে এক গুপ্তঘাতকের হাতে পেশােয়া নারায়ণ রাও নিহত হলে রঘুনাথ রাও নিজেকে পেশােয়া বলে ঘােষণা করেন ।
  • এরপর মারাঠা সর্দার নানা ফড়নাবীশ [Nana Phadnavis] প্রমুখ মারাঠা নেতারা রঘুনাথ রাও-কে গদিচ্যুত করে নারায়ন রাওয়ের শিশুপুত্র দ্বিতীয় মাধবরাও নারায়নকে পেশোয়া পদে অভিষিক্ত করেন ।
  • সুরাটের সন্ধি :রঘুনাথ রাও পেশােয়া পদ পুনরুদ্ধারের জন্য ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৭ মার্চ ইংরেজদের সঙ্গে সুরাটের সন্ধি করেন। সন্ধির শর্তানুসারে স্থির হয় রঘুনাথ রাওকে ইংরেজ ২৫০০ সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবে ও তার ব্যয় রঘুনাথ রাও বহন করবেন। রঘুনাথ রাও সুরাট ও ব্রোচ-এর রাজস্বের এক অংশ এবং সলসেট ও বেসিন ইংরেজদের দিতে রাজি হন।
  • রঘুনাথ রাও ও ইংরেজদের যুগ্ম বাহিনী আরাসের যুদ্ধে পেশােয়াকে পরাস্ত করে ১৭৭৫ এর মে মাসে।
  • পেশােয়া মাধব রাও সহ মারাঠা সর্দারেরা পুরন্দরের দুর্গে আশ্রয় নেন । ইংরেজগণ রঘুনাথকে পেশােয়া বলে ঘােষণা করে ।
  • পুরন্দরের সন্ধি :ইতিমধ্যে ব্রিটিশ পার্লমেন্টে ‘ রেগুলেটিং আইন ’ ( Regulating Act 1773 ) পাশ হয়ে গিয়েছে । এই আইনবলে বাংলার ব্রিটিশ গভর্নরকে ‘ গভর্নর জেনারেল’আখ্যা দেওয়া হয় এবং সপরিষদ গভর্নর জেনারেলের অনুমতি ছাড়া বােম্বাই ও মাদ্রাজের গভর্নরদের যুদ্ধ বা শান্তি বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় । তাই গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস বােম্বাইস্থ ইংরেজ কর্তৃপক্ষের একতরফা ভাবে স্বাক্ষরিত সুরাট সন্ধিকে বাতিল বলে ঘােষণা করে । তারা কর্নেল আপটনকে পুনার প্রকৃত মারাঠা কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝােতার জন্য প্রেরণ করেন । কর্নেল আপটন মারাঠাদের সাথে ‘ পুরন্দর ’ -এর সন্ধি স্বাক্ষর করেন । এই সন্ধি দ্বারা ─
    • ইংরেজগণ দ্বিতীয় মাধব রাও কে পেশোয়া বলে মেনে নেয় ।
    • রঘুনাথ রাওকে গুজরাটের কোষারগাঁওয়ে বসবাস করার এবং বছরে তিনলক্ষ টাকার বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করেন।
    • কোম্পানি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ১২লক্ষ টাকা এবং সলসেট ও থানা অঞ্চল লাভ করে ।
  • ‘ পুরন্দরের সন্ধি ’ বােম্বাইয়ের ইংরেজ কর্তৃপক্ষের মনঃপূত ছিল না । তাই তারা ইংল্যান্ডের ডাইরেক্টর সভার কাছে কলিকাতা কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন করে । ডাইরেক্টর সভা শেষ পর্যন্ত পুরন্দরের সন্ধিকে নাকচ করে সুরাটের সন্ধিকেই বহাল রাখেন ।
  • উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস রঘুনাথ রাও এর পক্ষ অবলম্বন করলে প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে ।
  • আসন্ন ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে নানা ফড়নবিশ মহীশূরের রাজাকে মারাঠাদের পক্ষে আনতে সক্ষম হন ।
  • ইংরেজ বাহিনী পুনা অভিমুখে অগ্রসর হলে মহাদজী সিন্ধিয়া তেলিগাঁও নামক স্থানে তাদের বাধা দেন । তেলিগাঁও এর যুদ্ধে ( ১৭৭৯ খ্রিঃ ) পরাজিত হয়ে ইংরেজগণ ওয়াড়গাঁও এর সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় ।
  • কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস এই অপমানজনক সন্ধি মানতে অস্বীকার করেন এবং বাংলা থেকে গােডার্ড এর নেতৃত্বে নতুন বাহিনী প্রেরণ করেন । প্রাথমিকভাবে সাফল্য লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত গােডার্ড মারাঠাদের হাতে পরাজিত হন । অতঃপর ইংরেজ বাহিনী সিন্ধিয়ার রাজধানী গােয়ালিয়র দখল করতে সক্ষম হয় । শেষ পর্যন্ত এই দীর্ঘস্থায়ী ও ফলহীন যুদ্ধ শেষ করার জন্য উভয় পক্ষের আগ্রহ দেখা দেয় ।
  • সলবাই এর সন্ধি ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ১৭ মে মহাদজি সিন্ধিয়ার মধ্যস্থতায় পেশােয়া ও ইংরেজদের মধ্যে সবাইয়ের সন্ধি হয়। সলবাই এর সন্ধির শর্তানুযায়ী ―
    • ইংরেজগণ সমস্ত বিজিত অঞ্চল মারাঠাদের ফিরিয়ে দেয় ।
    • ইংরেজগণ সলসেট ও থানা অঞ্চল লাভ করে ।
    • দ্বিতীয় মাধব রাও পেশােয়া রূপে স্বীকৃত হন ।
    • রঘুনাথ রাওকে মাসিক ভাতাদানের ব্যবস্থা করা হয় ।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮০৩-১৮০৫)

  • পেশােয়া দ্বিতীয় মাধব রাও অপুত্রক অবস্থায় মারা যান ( ১৭৯৬ খ্রিঃ ) । অতঃপর পেশােয়া হন রঘুনাথ রাও -এর পুত্র দ্বিতীয় বাজীরাও ( ১৭৯৬-১৮১৮ খ্রিঃ ) ।
  • তিনি ছিলেন বয়সে নবীন , অস্থিরচিত্ত ও ব্যক্তিত্বহীন । মারাঠা রাষ্ট্রসংঘের নেতৃত্ব দেবার মতাে দূরদর্শিতা তার ছিল না ।
  • দৌলতরাও সিন্ধিয়া ও যশবন্তরাও হােলকার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব হলে দ্বিতীয় বাজীরাও সিন্ধিয়ার পক্ষ নেন এবং হােলকারের কাছে পরাজিত হন।
  • হােলকার অমৃত রাও নামক জনৈক ব্যক্তিকে পেশােয়া বলে ঘােষণা করেন ।
  • বেসিনের চুক্তি:রাজ্যচ্যুত হয়ে পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাও ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে ওয়েলেসলি প্রবর্তিত অধীনতা মূলক মিত্রতা নীতি গ্রহন করে ইংরেজদের সঙ্গে বেসিনের চুক্তি করেন। এই চুক্তির শর্ত অনুসারে ―
    • ইংরেজগণ বাজীরাও পেশােয়া পদে বসতে সাহায্য করবে ।
    • এই সাহায্যের ব্যয় নির্বাহের জন্য পেশােয়া তার রাজ্যের একাংশ ইংরেজদের দান করবেন ।
    • ইংরেজদের অনুমতি ছাড়া পেশােয়া কোনাে শক্তির সাথে সন্ধি করতে পারবেন না ।
    • মারাঠা সর্দারদের সাথে বিরােধের মীমাংসার জন্য পেশােয়া ইংরেজের মধ্যস্থতা মানতে বাধ্য থাকবেন ।
    • পেশােয়ার রাজ্যে তারই খরচে ইংরেজ বাহিনী মােতায়েন থাকবে ইত্যাদি ।
  • সিন্ধিয়া ও ভোসলে বেসিনের চুক্তি মানতে অস্বীকার করলে আর্থার ওয়েলেসলি অসই ( Assy ) – এর যুদ্ধে সিন্ধিয়া ও ভোঁসলেকে পরাজিত করেন ।
  • ভোঁসলে যুদ্ধ ত্যাগ করে ইংরেজের সাথে দেওগাঁও -এর সন্ধি স্বাক্ষর করেন । বালেশ্বর ও কটক ইংরেজের হস্তগত হয় ।
  • দৌলত রাও সিন্ধিয়া একাই উত্তর ভারতে যুদ্ধ চালিয়ে যান । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি লেক -এর হাতে প্রতাপগঞ্জ ও লসওয়ারির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ‘ সুর্জি-অর্জুনগাঁও -এর সন্ধি ’ স্বাক্ষর করেন এবং ব্রিটিশ অধীনতা মেনে নেন ।
  • যশােবন্ত রাও হােলকার ভরতপুরের রাজার সাথে মিত্রতা স্থাপন করে ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করেন । মাঝপথে ভরতপুরের রাজা যুদ্ধ ত্যাগ করে ইংরেজের পক্ষ গ্রহণ করেন । মিত্রহীন হােলকার পাঞ্জাবের শিখ নেতা রঞ্জিত সিংহের মিত্ৰতালাভের চেষ্টা করেন । কিন্তু রণজিৎ সিংহ ইংরেজের বিরুদ্ধাচরণ করতে অস্বীকার করেন । ফলে হােলকার একাই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে মনস্থ করেন । কিন্তু নবাগত গভর্নর জেনারেল জর্জবার্লো মারাঠা যুদ্ধের অবসান ঘােষণা করেন । হােলকারের সাথে ‘ রাজপুর ঘাটের সন্ধি ’ স্বাক্ষরিত হয় । সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে কিছু রাজ্য ফিরে পান ।

তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৮১৯)

  • বরােদার গাইকোয়াড় ছিলেন পেশােয়ার সামন্ত । পেশােয়াকে প্রদেয় গাইকোয়াড় -এর কর অধিক দিন বাকি পড়ায় উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় । এই বিরােধ মীমাংসার জন্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ মধ্যস্থতা শুরু করে । সেই মতাে গাইকোয়াড় -এর মন্ত্রী গঙ্গাধর শাস্ত্রী ইংরেজ প্রহরাধীনে পেশােয়ার দরবারে উপস্থিত হন ।
  • এদিকে গাইকোয়াড় এবং গঙ্গাধর শাস্ত্রী উভয়েই ছিলেন ব্রিটিশ তাবেদার । তাই এদের প্রতি অন্যান্য মারাঠাদের ক্ষোভ ছিল ।
  • পেশােয়ার মন্ত্রী ত্রিম্বকজী ডিংলে ছিলেন বিচক্ষণ , দেশপ্রেমিক এবং ইংরেজ বিদ্বেষী । ইংরেজের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে মারাঠাদের ঐক্যবদ্ধ করার পেছনে তার বিশেষ অবদান ছিল ।
  • গঙ্গাধর শাস্ত্রী পুনায় আসার পর আততায়ীর হাতে নিহত হন ( ১৮১৫ খ্রিঃ ) । ইংরেজগণ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ত্রিম্বকজীকে দায়ী করে এবং পুনায় তাকে বন্দি করে রাখা হয় ।
  • এক বছরের মধ্যেই ত্রিম্বকজী বন্দিদশা মুক্ত হয়ে আত্মগােপন করেন । ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এজন্য পেশােয়াকে দায়ী করে এবং ত্রিম্বকজীকে ধরে দেবার জন্য পেশােয়ার উপর চাপ দিতে থাকে । অবশ্য পেশােয়া ইংরেজের দাবিকে নস্যাৎ করে দেন ।
  • পুনা সন্ধি:কোম্পানী পিন্ডারী দস্যুদের দমনে উদ্যোগী হলে পিন্ডারী নেতা করিম খাঁ, ওয়াশিল মহম্মদ ও চিতু পেশােয়ার সঙ্গে যােগ দেন।
  • ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে লর্ড হেস্টিংস পেশােয়াকে পুনার সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। সন্ধির শর্তানুসারে পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাও মারাঠা সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব ত্যাগ করেন, রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দেন এবং বিনা অনুমতিতে কারাের যােগাযােগ স্থাপনে বিরত থাকেন।
  • পেশােয়া বিদ্রোহ ঘােষণা করলে সিন্ধিয়া, হােলকার ও ভোসলে তার সঙ্গে যােগ দেয়।
  • ভোসলের আগ্লা সাহেব ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে সীতাবলদীর যুদ্ধে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ফিটজেরাল্ডের কাছে পরাস্ত হন। তিনি অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মেনে নেন।
  • হােলকার বিতল বা ভিটল রাও ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের কাছে মাহিতপুরের যুদ্ধে পরাস্ত হন।
  • ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে পেশােয়া কোরেগাঁও, কিরকি এবং অস্টির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতি মেনে নেন। পেশােয়া পদ লুপ্ত করে তার রাজ্য কোম্পানীর সাম্রাজ্যভুক্ত হয় ও তাকে বার্ষিক ৮.৫ লক্ষ টাকা বৃত্তি দিয়ে বিরে নির্বাসন দেওয়া হয়।
  • দ্বিতীয় বাজিরাও ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। সারা রাজ্যে শিবাজির বংশধর প্রতাপ সিংহকে বসানাে হয়। দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের দত্তকপুত্র ছিলেন নানাসাহেব বা ধন্দুপন্থ।